আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের জন্য বড় কোনো শক্তি সক্রিয় হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “দেশের ভেতর থেকে ও বাইরে থেকে অনেক শক্তি নির্বাচনের বিরুদ্ধে কাজ করবে। ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হবে। হঠাৎ আক্রমণ আসতে পারে। তবে যত ঝড়-ঝাপটা আসুক, আমাদের তা অতিক্রম করতে হবে।”
বুধবার (২৯ অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে তিনি এ সতর্কতা দেন। প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে চারটি মূল বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়—মাঠ প্রশাসনের পদায়ন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য মোকাবিলা।
বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা জানান, ভুয়া ও অপতথ্য মোকাবিলার বিষয়টি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সরকার আশঙ্কা করছে, নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে ভুয়া তথ্য ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালানো হতে পারে।
বৈঠক শেষে প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার আসবে। এআই ব্যবহার করে ছবি ও ভিডিও বানিয়ে প্রচার করা হবে। একবার অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়লে তা ঠেকানো কঠিন—তাই শুরুতেই প্রতিহত করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, আক্রমণ বলতে শুধু শারীরিক নয়, সাইবার হামলা বা অপতথ্য ছড়ানোকেও বোঝানো হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে সতর্ক করে বলেন, “যারা পতিত স্বৈরাচার ও তার দোসর, তারা দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না। তাদের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে হবে।”
অধ্যাপক ইউনূস নির্দেশ দিয়েছেন, ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে নির্বাচন কমিশন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে আরও বেশি সংখ্যক তথ্যচিত্র ও ভিডিও তৈরি করতে হবে। এসব ভিডিও দ্রুত ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশের নির্দেশও দেন তিনি।
প্রেস সচিব জানান, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “মানুষকে জানাতে হবে—ভোটকেন্দ্রে কীভাবে ভোট দিতে হয়, বিশৃঙ্খলা হলে কী করতে হয়। জনগণ যেন প্রস্তুত থাকে, সে লক্ষ্যেই এই প্রচারণা।”
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, জেলা প্রশাসক (ডিসি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)সহ যারা গত তিনটি নির্বাচনে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের এবারের নির্বাচনে দায়িত্বে রাখা হবে না। পদায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, কর্মদক্ষতা, শারীরিক যোগ্যতা ও সততা যাচাই করা হবে।
প্রেস সচিব জানান, “নিজ জেলা বা শ্বশুরবাড়ির এলাকায় কাউকে পদায়ন করা হবে না। আত্মীয়স্বজন প্রার্থী হলে সেই এলাকায়ও দায়িত্ব দেওয়া হবে না। মাঠ প্রশাসনে পদায়ন কার্যক্রম শুরু হবে ১ নভেম্বর থেকে।”
তিনি আরও বলেন, “স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, পুলিশের ক্ষেত্রেও একই নীতিতে পদায়ন হবে। ইতিমধ্যে ৬৪ জেলার এসপি পর্যায়ের তালিকা প্রস্তুত হয়েছে।”
বৈঠকে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ প্রস্তুতির বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে এবং ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সব নিরাপত্তা প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচনে সেনা ও নৌবাহিনীর প্রায় ৯২ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবেন, এর মধ্যে ৯০ হাজার সেনাসদস্য। নির্বাচনের ৭২ ঘণ্টা আগে থেকে এবং ৭২ ঘণ্টা পর পর্যন্ত বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য প্রতিহত করতে দুটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হবে, যা উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কাজ করবে। এই কমিটিগুলো তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য যাচাই করে সঠিক তথ্য প্রচার করবে। এ বিষয়ে আইসিটি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে প্রযুক্তিগত সহায়তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
প্রেস ব্রিফিংয়ে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রচার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রেস সচিব বলেন, “ওনার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ রয়েছে। আলজাজিরা ও বিবিসি উভয়েই তাঁর নির্দেশে হত্যার প্রমাণ প্রকাশ করেছে। তাই যারা তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তাদের এই প্রেক্ষাপট ভুলে যাওয়া উচিত নয়।”
তিনি আরও বলেন, “যারা চুরি করা টাকা বিদেশে পাঠিয়েছে, তারাই এখন সেই অর্থে বিদেশি ল ফার্ম ভাড়া করে এসব প্রচারণা চালাচ্ছে। এটা জাতির সঙ্গে প্রতারণা।”
চলমান সময়/৩০ অক্টোবর/পিএস



