লেখাটি আনোয়ার হোসেন রাসেদ‘র ফেইজবুক থেকে হুবহু তুলে ধরা হলো
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=761717077705136&id=100016005512108
আমরা বাঙালী, আমরা বাংলাদেশী
জাতিসত্তা আর নাগরিকত্ব এক জিনিস নয়, এক বিষয় নয়, এক কথা নয়, এক ব্যাপার নয়। দুইটিই ভিন্ন জিনিস, ভিন্ন বিষয়, ভিন্ন কথা, ভিন্ন ব্যাপার। জাতিসত্তা নির্ধারিত হয় ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ধর্মের উপর ভিত্তি করে। আর নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয় ভৌগলিক সীমারেখার উপর ভিত্তি করে। একটা দেশের স্থায়ী অধিবাসী বিভিন্ন জাতিসত্তার লোক হতে পারে, বিভিন্ন জাতিসত্তার লোক একটি দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারে কিন্তু একটা দেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার নাগরিকত্ব বিভিন্ন হতে পারেনা, জাতিসত্তা বিভিন্ন হলেও নাগরিকত্ব হবে একটাই। ভৌগলিক সীমারেখার সাথে নাগরিকত্ব পাল্টায় কিন্তু জাতিসত্তা কখনও পাল্টায় না। যেমন যাদের মাতৃভাষা ইংরেজী তারা ইংরেজ, ইংরেজদের আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে। যাদের মাতৃভাষা আরবী তারা আরব, আরবদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে। ইংল্যান্ড/বৃটেন/যুক্তরাজ্য, আমেরিকা/যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এসব দেশের স্থায়ী বাসিন্দারা ইংরেজীতে কথা বলে, এদের মাতৃভাষা ইংরেজী, তাই এদের জাতিসত্তা হল ইংরেজ। কিন্তু এদের কারোই নাগরিকত্ব ইংরেজ নয়, কারোই নাগরিকত্ব এক নয়, কারো নাগরিকত্ব বৃটিশ, কারো আমেরিকান, কারো কানাডিয়ান এবং এটা নির্ধারিত হয়েছে ভৌগলিক সীমারেখার উপর ভিত্তি করে। আবার সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ইরাক, মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, ইয়েমেন, বাহরাইন এসব দেশের স্থায়ী বাসিন্দারা আরবিতে কথা বলে, এদের মাতৃভাষা আরবী, এদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এক, তাই এদের জাতিসত্তা হল আরবি। কিন্তু এদের কারোই নাগরিকত্ব আরবি নয়, কারোই নাগরিকত্ব এক নয়, কারো নাগরিকত্ব সৌদি, কারো আমিরাতি, কারো কাতারি, কারো কুয়েতি, কারো ইরাকি, কারো মিশরি, কারো সিরিয়, কারো জর্ডানি, কারো ইয়েমেনি, কারো বাহরাইনি এবং এটা নির্ধারিত হয়েছে ভৌগলিক সীমারেখার উপর ভিত্তি করে। আবার ধর্মের উপর ভিত্তি করে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, ইহুদী, শিখ সহ বিভিন্ন জাতি রয়েছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এদের বসবাস রয়েছে। কোথাও ধর্মের দিক দিয়ে নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয়নি। একটা দেশে বিভিন্ন ধর্মের লোক বসবাস করে, যে যেই দেশে বসবাস করে সে যেই ধর্মের লোক হোকনা কেন তার ধর্মের উপর ভিত্তি করে তার নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয় না, বসবাসকারী দেশের উপর ভিত্তি করে নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয়। যেমন আমেরিকা/যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মের দিক দিয়ে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, ইহুদী সহ বিভিন্ন জাতি বসবাস করে, এদের কারোই ধর্মীয় দিক দিয়ে নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয়নি, এদের সবার নাগরিকত্ব নির্ধারিত হয়েছে ভৌগোলিক সীমারেখার উপর ভিত্তি করে, এরা ধর্মীয় দিক থেকে বিভিন্ন জাতি হলেও এদের সবার নাগরিকত্ব আমেরিকান। ঠিক তেমনি আমাদের মাতৃভাষা হল বাংলা, তাই ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে আমাদের জাতিসত্তা হল বাঙালী, কিন্তু নাগরিকত্ব বাঙালী নয়, নাগরিকত্ব হল বাংলাদেশী এবং সেটা নির্ধারিত হয়েছে ভৌগোলিক সীমারেখার উপর ভিত্তি করে। এই উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এক সময় একটি দেশ ছিল। যখন আমাদের দেশ ভারত ছিল তখন আমাদের নাগরিকত্ব ছিল ভারতীয়, যখন পাকিস্তান ছিল তখন নাগরিকত্ব ছিল পাকিস্তানি, আর এখন আমাদের দেশ হল বাংলাদেশ তাই এখন আমাদের নাগরিকত্ব হল বাংলাদেশী, অর্থাৎ ভৌগলিক সীমারেখার সাথে আমাদের নাগরিকত্ব পাল্টেছে, বিভিন্ন ভৌগলিক সীমারেখায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাগরিকত্ব হয়েছে। কিন্তু জাতিসত্তা বিন্দুমাত্র ও পাল্টায়নি, যখন ভারতের অধিবাসি ছিলাম, যখন পাকিস্তানের অধিবাসি ছিলাম তখন যা ছিল এখন বাংলাদেশের অধিবাসী অবস্থায় ও তাই আছে, অর্থাৎ জাতিসত্তা বাঙালীই আছে। আর আমাদের দেশে এই বাঙালী আর বাংলাদেশী নিয়ে অনর্থক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়। এক পক্ষ বলে আমরা বাঙালী, আরেক পক্ষ বলে আমরা বাংলাদেশী। যারা বাঙালী বলে তারাও জানে তারা কি? আর যারা বাংলাদেশী বলে তারাও জানে তারা কি? পারস্পরিক বিতর্ক ছাড়া আমরা সবাই আমাদের আচার-আচরণে, কথা-বার্তায়, প্রকাশ করি, স্বীকার করি আমরা বাঙালী ও বাংলাদেশী। অর্থাৎ আমাদের জাতিসত্তা হল বাঙালী আর নাগরিকত্ব হল বাংলাদেশী। তাই আমরা বাঙালী, আমরা বাংলাদেশী। আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে জাতীয়তা উল্লেখ ছিল বাঙালী, পরবর্তীতে আবার সংবিধান সংশোধন করে জাতীয়তা বাংলাদেশী করা হয়েছিল, এখন আবার সংবিধান সংশোধন করে জাতীয়তা বাঙালী করা হয়েছে, কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন ফরম পূরণের সময় জাতীয়তা লিখা হয়, লিখতে হয় বাংলাদেশী। এটা কি স্ববিরোধী নয়? এটা কি সঠিক? এটা মোটেও সঠিক নয়, একেবারে তালগোল পাকানো অবস্থা, একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা। পৃথিবীর কোন দেশেই জাতিসত্তা ও নাগরিকত্ব নিয়ে এমন তালগোল পাকানো অবস্থা এমন লেজেগোবরে অবস্থা নেই, এমন অহেতুক বিতর্ক নেই। এটা আমাদের চরম হীনমন্যতারই বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং অহেতুক বিতর্ক না করে সংবিধান সংশোধন করে আমাদের জাতীয়তা বাঙালী এবং নাগরিকত্ব বাংলাদেশী করা উচিৎ। তাহলেই অহেতুক সকল বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারবো এবং একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলাদেশ গড়তে পারবো।
Leave a Reply