19.3 C
New York
Wednesday, June 18, 2025
spot_img

ইরান-ইসরাইল হামলা পাল্টা হামলা, অস্ত্র বাণিজ্যই লক্ষ্য ট্রাম্পের

বিশ্ব সময় ডেস্ক, চলমান সময়

বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু এখন ইরান ও ইসরায়েল। প্রতিদিনই নতুন নতুন হুমকি, পাল্টা জবাব আর সামরিক মোতায়েনের মধ্যে দিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি সারা বিশ্বের জন্য ভয়ংকর অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’র আড়ালে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বহু পুরনো একটি ব্যবসায়িক কৌশল—অস্ত্র বাণিজ্য।

ইতিহাসবিদ মাইকেল লেডিনের ‘লেডিন ডকট্রিন’-এর বরাত দিয়ে ২০০২ সালে ন্যাশনাল রিভিউ–তে বলা হয়েছিল, “প্রতি ১০ বছর পরপর যুক্তরাষ্ট্র একটি ছোট্ট দেশকে আক্রমণ করে, শুধু বিশ্বকে দেখানোর জন্য যে আমরা ব্যবসা বুঝি।” সেই কথারই যেন বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিতে। পারস্য উপসাগরে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি, ইরানের বিরুদ্ধে সরব অবস্থান এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থার ছায়া—সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে অস্ত্র বিক্রির এক সুবর্ণ ক্ষেত্র।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যেই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জর্ডানের সঙ্গে বড় অস্ত্র বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিস্থিতিতে ডেমোক্রেটিক সিনেটর ক্রিস মারফি টুইট করে মন্তব্য করেন, “ইরানকে ভয় দেখিয়ে সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রি করতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন।” একইভাবে রয়টার্স জানায়, ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে আনা অস্ত্রও সৌদি আরবের কাছে বিক্রির পরিকল্পনা করা হয়েছে।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ঠেকানোর নামে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করেছে ড্রোন, যুদ্ধবিমান ও প্রায় দেড় হাজার সেনা। ইরানকে ঘিরে ভয়ভীতি তৈরি করে একদিকে যেমন কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে সুযোগ নিচ্ছে অস্ত্র বাণিজ্যের। নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, ইরান হুমকির অজুহাতে সৌদি আরব নিজস্ব পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক কোম্পানি সহযোগিতা করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ইরান-ইসরায়েলসহ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেই যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বাণিজ্যের মাধ্যমে একদিকে অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করছে, অন্যদিকে নিজেদের সামরিক আধিপত্য ধরে রাখছে। ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপগুলো তাই কৌশলগত যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি ‘লাভজনক ব্যবসার খেলা’ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার সংঘাতে নড়েচড়ে বসেছে পুরো বিশ্ব। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব দেশেই নাক গলাতে আসে। ফলে সেসব দেশের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। এর নেপথ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বাণিজ্য। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুদ্ধ লাগিয়ে অস্ত্র বিক্রির ফায়দা নেয়। মেক্সিকো থেকে শুরু করে ইরান পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । তারই ধারাবাহিক বিবরণ তুলে ধরা হলো-

মেক্সিকো যুদ্ধ

মেক্সিকো যুদ্ধই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম যুদ্ধ। এটি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস কে পোলকের চাপিয়ে দেওয়া একটি যুদ্ধ। ১৮৪৬-১৮৪৮ সালে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই দু’ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে। এ যুদ্ধের প্রধান কারণ ছিল টেক্সাস। যা এক দশক আগে মেক্সিকোর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। চূড়ান্তভাবে জয়ী হওয়ার পর মেক্সিকোর ভূখণ্ডের ৩ ভাগের ১ ভাগ আমেরিকার দখলে চলে যায়। মেক্সিকো যুদ্ধে ১৩,২৮৩ মার্কিন সেনা নিহত হয়।

স্পেন যুদ্ধ

১৮৯৮ সালে স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র। এটি ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধ ছিল। একে ইতিহাসের প্রথম ‘গণমাধ্যম যুদ্ধ’ বলা হয়। মনরো মতবাদের প্রেক্ষাপটে মার্কিন কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে এ যুদ্ধ ঘোষণা করে। চার মাস স্থায়ী সেই যুদ্ধে ২,৪৪৫ মার্কিন সদস্য মারা যায়। বিপরীতে প্রায় ১৬,০০০ স্প্যানিশ সৈন্য প্রাণ হারায়। এ যুদ্ধের ব্যয় ধরা হয় ১০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ঊনবিংশ শতকের শেষভাগেই একটি বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

জার্মানি যুদ্ধ

১৯১৪ সালে ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হয়। একে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বলা হয়। এ যুদ্ধের প্রথম তিন বছর যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ ছিল। ১৯১৭ সালের ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়। তার ১৯ মাস পর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এ যুদ্ধে ১,১৬,৫১৬ জন মার্কিন সেনা মারা যায়। এতে ৩৮১.৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র।

ইউরোপীয় যুদ্ধ

১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে জাপানিদের বোমা বর্ষণের পরদিনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রজোটে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানি ও ইতালি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার তিন দিন পরই যুক্তরাষ্ট্রও দেশ দু’টির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। ১৯৪৫ সালের মে মাসে ইউরোপীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। আগস্টে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলার নির্দেশ দেন। যার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে সে বছরই আত্মসমর্পণ করে জাপান।

কোরিয়ান যুদ্ধ

১৯৫০ সালে কোরিয়ান যুদ্ধের শুরু। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুমান উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীকে দক্ষিণ থেকে উৎখাত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের সমর্থন নেয়। তৎকালীন মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থারের কাজকে যুদ্ধ হিসেবে ব্যাখ্যা করে সংঘর্ষে জড়ায় চীন। ডুইট আইজেনহোয়ার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এ যুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৮৯.৮১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়। এতে প্রায় ৩৬,০০০ মার্কিন সেনা মারা যায়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ

এটি মার্কিন ইতিহাসের এক ব্যর্থ যুদ্ধ। ১৯৫৪ সালে ভিয়েতনামিরা ফরাসিদের পরাজিত করে উপনিবেশবাদ যুগের অবসান ঘটায়। ১৯৫৫ সালে আঞ্চলিক একটি সংঘাত থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ রূপ নেয়। ১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর দিয়েমকে হত্যা করা হয়। নতুন সামরিক নেতৃত্বাধীন দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকার ভিয়েতনামিদের সমর্থন হারাতে শুরু করে। ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে যুদ্ধের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনসাধারণের সমর্থন হারাতে শুরু করে। ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় আমেরিকা। ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট উত্তর ভিয়েতনামের কাছে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৮৪৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়। যুদ্ধে ৫৮,০০০ সেনা নিহত হয়।

ইরাক যুদ্ধ

প্রচলিত আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে ইরাকে হামলা চালায়। ইরাকের এ সংঘাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় ১ ট্রিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়। সাদ্দামের কাছে ব্যাপক অস্ত্র রয়েছে বলে মার্কিন সেনারা ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমণ করে। দেশটি এখনো সংঘাত ও সন্ত্রাসের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত। এখন পর্যন্ত সাদ্দাম হোসেনের সেই বিধ্বংসী অস্ত্রের সন্ধান দিতে পারেনি আমেরিকা। ৭ বছর ৫ মাসব্যাপী এ যুদ্ধে ৪,৪১০ জন মার্কিন সেনা মারা যায়।

আফগান যুদ্ধ

২০০১ সালে শুরু হয় আফগান যুদ্ধ। যা এখনো চলছে। ২০০১ সালে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল-কায়েদা হামলা চালিয়েছে এমন অভিযোগে আফগান সরকারের কাছে লাদেনকে হস্তান্তর করার আহ্বান জানায়। তালেবানরা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ২০০১ সালের হামলার পর থেকে আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক জোট বাহিনীর প্রায় সাড়ে ৩ হাজার সৈন্য মারা যায়। এরমধ্যে ২,৩০০ জনেরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রের। এ সংঘাতে ৩২ হাজারেও বেশি বেসামরিক লোক মারা যায়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে এখনো তালেবান-মার্কিন শান্তি আলোচনা চলছে।

ইরান যুদ্ধ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের জেনারেল কাসেম সোলেইমানি নিহত হওয়ার পর বিশ্বপরিস্থিতি উত্তেজনাকর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। ইরান আর আমেরিকার পাল্টাপাল্টি হুমকির মুখে ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে ইরান ১ ডজনের বেশি ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা চালিয়েছে। সোলেইমানিকে দাফনের একটু আগেই ইরানের স্থানীয় সময় ৮ জানুয়ারি রাত দেড়টার দিকে এ হামলা শুরু হয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয়েছে, সোলেইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যার জবাব হিসেবে এ হামলা করা হয়েছে। তারা এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন শহীদ সোলেইমানি’।

২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে ইসরায়েল ইরানে হামলা চালায়। ইরানের কথিত পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংসের দাবিতে গত শুক্রবার (১৩ জুন) ভোররাতে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামের এই অভিযানে ইরানের শীর্ষ সামরিক নেতাদের হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী।

এর জবাব দিতে দেরি করেনি তেহরান। পরদিনই শক্তিশালী পাল্টা হামলা শুরু করে ইরান। ফলে ইসরায়েলের ভেতরে একাধিক স্থানে বিস্ফোরণ ঘটে, ভেঙে পড়ে আবাসিক ভবন, আগুন ধরে যায় বিভিন্ন স্থানে। পাল্টাপাল্টি হামলায় উভয় দেশের কয়েকশ মানুষ হতাহত হয়।

ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি এবং সামরিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে নাতানজের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, ইসফাহানের একটি পারমাণবিক স্থাপনা এবং কামানশাহর মতো স্থানগুলো প্রধান। নাতানজের স্থাপনাটি জাতিসংঘের পারমাণবিক নজরদারি সংস্থা দ্বারা ‘ধ্বংস’ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বেরি এবং বিপ্লবী গার্ডসের প্রধান মেজর জেনারেল হুসেইন সালাম-সহ শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও অন্তত ছয়জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী এই হামলায় নিহত হয়েছেন। ইরানের হাজার হাজার সাধারণ মানুষও মারা গেছে।

চলমান সময়/১৮জুন/পিএস

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

যোগাযোগ রেখো

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

এ সম্পর্কিত খবর