28.1 C
New York
Thursday, June 19, 2025
spot_img

বিরোধীদের দমনেই গুমকে ‘অস্ত্র’ বানিয়েছিল বিগত সরকার: গুম কমিশন

নিজস্ব প্রতিবেদক, চলমান সময়

প্রধান উপদেষ্টার কাছে গুম কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়েছে গত ৪ জুন। প্রতিবেদনে বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত দমননীতির অংশ হিসেবে গুমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে কমিশন।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এই কথা জানান।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, কমিশনে দাখিল করা অভিযোগগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুমের শিকার ভুক্তভোগীদের সম্ভাব্য ৪ ধরনের পরিণতি হয়েছে। এর মধ্যে তাকে হত্যা করা হয়। ২. তাকে বিচারের আগেই মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করে সাধারণত জঙ্গি তকমা দিয়ে বাংলাদেশেই বিচারাধীন বা নতুন ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ৩. তাকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা হয় এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরেও বহু অপরাধী ও তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের অবস্থানে থাকায় অনেক জোরালো প্রমাণ ও নিদর্শন ধ্বংস, অনেক ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানারকম ভীতিকর ও আতঙ্কজনক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তবুও বহু ভুক্তভোগী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের অভিযোগ ও অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিস্তারিতভাবে সে কাহিনী তুলে ধরেছেন। গোপন আটক কেন্দ্রের অস্তিত্ব এখন আর অস্বীকার করা যায় না। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা কিছু আটক কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন এবং সেখানে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শুনেছেন যা মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে।

গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির সভাপতি বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপনমূলে গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি গঠনের পর বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের শনাক্ত এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছিল তা নির্ধারণের জন্য কাজ শুরু করে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর কথিত ‘আয়না ঘর’ নামের বন্দিশালার স্থান-স্থাপনা পরিদর্শন করা হয় এবং ওই তারিখেই অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত উপরোল্লিখিত স্থান-স্থাপনার কোনোরূপ পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন বা বিয়োজন না ঘটানোর জন্য পত্র প্রদান করা হয়। এখন পর্যন্ত শুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য সারাদেশে মোট ১৬টি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করা হয়েছে।

এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তথ্য প্রাপ্তির পরপরই তাৎক্ষণিকভাবেও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কমিশন অব ইনকোয়ারি এ্যাক্ট-এর ধারা ১০ এ (১) ও (২) অনুযায়ী কমিশনে দাখিলকৃত গুম সংক্রান্ত অভিযোগগুলোর মধ্য থেকে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ও চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি এবং ২৫ মার্চ ৩টি পত্রমূলে মোট ১৩১টি অভিযোগের বিষয়ে আইন মোতাবেক এফআইআর বা জিডি রেকর্ডের পর ভুক্তভোগীদের সন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পুলিশের আইজিপি বরাবর প্রেরণ করা হয়েছে।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন এই প্রতিবেদনে প্রায় ১৮৫০ অভিযোগ বিশ্লেষণের মধ্যে থেকে ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে যাদের ৩টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে- ১. নিখোঁজ হওয়ার সময়ে তাদের নিকটাত্মীয়ের দায়ের করা সাধারণ ডায়েরি, ফৌজদারি মামলা, গুম থাকাবস্থায় সংবাদ প্রতিবেদনের মতো সমসাময়িক প্রমাণ রয়েছে। শুধুমাত্র এই ২৫৩ জন সমসাময়িক প্রমাণ দাখিল করতে সক্ষম হয়েছেন, বাকিরা হননি কারণ তখন এসব ক্ষেত্রে জিডি করতে গেলে জিডি নেওয়া হতো না। ২. গুম অবস্থা থেকে ফেরতের সময় তাদের সন্ত্রাসবিরোধী মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোনো একটি সংস্থা শিকার করে নেয় যে, ব্যক্তিটি তাদের হেফাজতে আছে। ৩. এই ভুক্তভোগীরা জীবিত আছেন তাই তারা কমিশনকে জানাতে পেরেছেন যে তারা রাষ্ট্রীয় হেফাজতে গোপন আটক কেন্দ্রে বন্দি ছিলেন, যেখানে তাদের অনেকের একে অপরের সঙ্গে দেখাও হয়েছে এবং একই ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন।

অর্থাৎ এই ২৫৩ ব্যক্তিকে গুম করার মুহূর্তে, গুমকালীন সময়ে এবং শুম থেকে ফেরত আসার মুহূর্তে তিনটি পর্যায়ই অকাট্য প্রমাণাদি পাওয়া যাচ্ছে।

অতএব আমাদের কাছে ২৫৩ জন মানুষের একটি তথ্যভিত্তিক দলিল রয়েছে, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এবং এক দশকেরও বেশি সময় ধরে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এমন ঘটনা কাকতালীয় হওয়া সম্ভব নয়; এমনকি হাতে গোনা কিছু অবাধ্য কর্মকর্তার বিচ্ছিন্ন অপরাধও হতে পারে না। এই অভিজ্ঞতার সাদৃশ্যতা একটি সাংগঠনিক ও পদ্ধতিগত কাঠামোর অস্তিত্ব নির্দেশ করে। এতে স্পষ্ট হয় যে বিগত সরকারের শাসনামলে গুম একটি সুশৃঙ্খল ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপে “জঙ্গিবাদবিরোধী” অভিযানের ছায়াতলে ইসলামী উগ্রবাদের হুমকিকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন এবং শাসন দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে যার ভুক্তভোগী ছিল মেধাবী শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি পেশাজীবী তথা সাধারণ জনগণ।

তিনি আরও বলেন, এছাড়াও আমাদের কাছে দাখিলকৃত ৮১ শতাংশ অভিযোগ জীবিত ভুক্তভোগীদের হলেও, ১৯ শতাংশ অভিযোগ ফেরত না আসা ভুক্তভোগীদের। এবারের প্রতিবেদনে আমরা গুম অবস্থা থেকে ফিরে না আসা এমন ১২ জন ভুক্তভোগীর বিষয়ে অগ্রগতি তুলে ধরেছি যাদের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে অনুসন্ধান সম্পন্ন হয়েছে এবং তাদের গুমের জন্য কারা দায়ী তা প্রাথমিকভাবে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছি। চলমান অনুসন্ধানের স্বার্থে এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে কমিশন সুনির্দিষ্টভাবে দুটি সুপারিশ দিয়েছে- প্রথমত, সন্ত্রাসবিরোধী মামলার অপব্যবহারের বিষয়ে অবগত হয়ে সেগুলো ন্যায় বিচারের মানদণ্ড বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা এবং দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে মানুষের মনস্ততত্ত্ব পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান কাউন্টার টেরোরিজম মেথড ত্রুটিপূর্ণ বিধায় মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মতো উপযুক্ত কাউন্টার টেরোরিজম মেথড বের করা।বাংলাদেশী সফটওয়্যার

গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে একটি বাস্তব হুমকি-বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ২০১৬ সালের হলি আর্টিজানে হামলার মতো ঘটনা এর প্রমাণ। তবে এই হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সততা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা জরুরি। সরকার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণাকে যখন রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তা আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।

চলমান সময়/১৯জুন/পিএস

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

যোগাযোগ রেখো

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

এ সম্পর্কিত খবর